জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে আহলে বায়তে রাসূল (রা) স্মরণে ১০ দিনব্যাপী ৩৭তম আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের শেষ দিনে হাজারো মানুষের ঢল
বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধ হানাহানি থামাতে কারবালার।চেতনায় শান্তিকামী মানুষের জাগরণ চাই
হাজার হাজার দ্বীনদার আহলে বায়তপ্রেমী মানুষের উচ্ছ্বাসমুখর উপস্থিতিতে দেশ ও বিশ্ববাসীর ওপর আল্লাহর রহমত কামনা এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও হানাহানি সংঘাত থামাতে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের জাগরণের আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে নগরীর জমিয়তুল ফালাহর ১০ দিনব্যাপী ৩৭ তম আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল ৯ আগস্ট (১০ মহরম) মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। আহলে বায়তে রাসূলের (দ.) ত্যাগ ও কীর্তিগাথা সকল স্তরের পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন, যুব তরুণদের অবক্ষয় ও বিপথগামিতা রোধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানানো হয় শাহাদাতে কারবালা মাহফিলে। শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা পর্ষদের আয়োজনে মঙ্গলবার শেষ দিনের মাহফিলে দেশি-বিদেশি আলোচক ও বক্তারা বলেছেন, কারবালা ময়দানে ইয়াজিদি নৃশংসতার কবর রচিত হলেও এখনো দেশে দেশে ইয়াজিদি প্রেতাত্মা রয়ে গেছে। শক্তিধর দেশগুলোর প্রতাপশালী শাসকরা আজ দুর্বল ছোট্ট দেশগুলোর দিকে অস্ত্র তাক করে যুদ্ধের হুঙ্কার ছেড়ে জঘন্য বর্বরতা-নির্দয়তা দেখাচ্ছে। নিষ্ঠুর শাসকদের দম্ভ চুরমার করে দেয়া, গণবিরোধী দুঃশাসন রুখে দেয়া এবং অধিকার বঞ্চিত মজলুম মানবতার পাশে দাঁড়ানোই হযরত ইমাম হোসাইন (রা) ও শাহাদাতে কারবালার দর্শন ও শিক্ষা।
শেষ দিনের মাহফিলে সভাপতিত্ব করেন মাইজভান্ডার দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন শাহজাদায়ে গাউসুল আজম হযরত শাহসূফি মাওলানা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আলহাসানী (মজিআ)। প্রধান অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। রাতে বাদে এশা দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন, সাবেক চউক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আবদুচ ছালাম। বিদেশি আলোচক ছিলেন গাউসুল আজম হযরত সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানি (রা) এর আওলাদ শাহসুফি সৈয়দ আফিফ আবদুল কাদের মনসুর আল জিলানি আলবাগদাদি। তিনি বলেন, আহলে বায়তে রাসূলের (দ) মর্যাদা সমুন্নত করেছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক। অন্যান্য নবীগণ নিজেদের সন্তান সন্ততি আওলাদদের জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছেন। অন্যদিকে আল্লাহ পাক কুরআন মজিদে আহলে বায়তে রাসূলের (দ) পবিত্রতা ও সুরক্ষার সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ পাক চান প্রিয় নবীর (দ) ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি। প্রিয় নবী (দ) বলেছেন, দ্বীন ইসলামের জন্য আমি যে অসীম ত্যাগ ও কুরবানি দিয়েছি, আমি এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না। চাই শুধু আমার আহলে বায়তের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা ও আনুগত্য। আল্লামা সৈয়দ আফিফ জিলানী বলেন, নামাজে দুরুদে আমরা প্রিয় নবী (দ) ও আওলাদে রাসুলের (দ) স্মরণ করি। তাঁদের স্মরণ ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা পর্ষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চেয়ারম্যান এবং পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ছোট বড় সবাইকে সালাম দেয়া, পরস্পর শান্তি কামনা করা এবং দুস্থ অভুক্ত মানুষকে খাওয়ানো এটাই ইসলামের নির্দেশনা। এ শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য, প্রিয় নবী (দ) ও আহলে বায়তে রাসূলের (দ) সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের লক্ষ্য। খতিবে বাঙাল আল্লামা জালাল উদ্দিন আলকাদেরী (রহ) এ মাহফিলের সূচনার মাধ্যমে সদকায়ে জারিয়া তথা প্রবহমান পুণ্যের ধারা রেখে গেছেন। এজন্য যুগে যুগে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আলহাসানী বলেন, আহলে বায়তে রাসূলের (দ) ভালোবাসা ও আনুগত্যই ঈমানের দাবি। হযরত ইমাম হাসান (রা) ও হযরত ইমাম হোসাইনকে (রা) ভালোবাসা ছাড়া কখনো ঈমানদার হওয়া যাবে না।
প্রধান অতিথি ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, দ্বীন ইসলামের মূলধারাই হচ্ছে সুন্নিয়ত। সুন্নিয়তের ওপর আমরা প্রতিষ্ঠিত। সুন্নিয়ত ব্যতীত ইসলামের ভিত্তি থাকতে পারে না। আজ সমগ্র বিশ্বে যুদ্ধের দামামা বাজছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর চলছে ইসরাইলি দমন নিপীড়ন ও নির্যাতন। ইসরাইল আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব শান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে চলা এই সংঘাত হানাহানি রুখে দাঁড়াতে কারবালার চেতনায় আমাদের জেগে উঠতে হবে। উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, জশনে জুলুস ও কারবালা মাহফিল আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য। যা বিভিন্ন সময়ে বন্ধের ষড়যন্ত্রও আমরা দেখেছি। একটি উগ্রবাদি গোষ্ঠি বাংলাদেশকে লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান বানাতে চায়। কট্টরবাদি উগ্রবাদি জঙ্গিবাদি অপতৎপরতা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের রুখে দিতে হবে। ধ্বংস, যুদ্ধ, দাঙ্গা, মারামারি ফেতনা ফাসাদে যারা লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। অস্ত্র ব্যবসা ও পকেট ভারি করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ হানাহানি সংঘাত চলছে বলে উপমন্ত্রী নওফেল বক্তব্যে উল্লেখ করেন। জমিয়তুল ফালাহর কারবালার মাহফিল কোনোদিন কোন অপশক্তি থামাতে পারবে না বলে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করেন। দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আল্লাহকে পেতে হলে প্রিয় নবী (দ) ও আহলে বায়তের প্রেম অন্তরে ধারণ করতে হবে। যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাস, সহিংসতা ও জঙ্গিবাদে লিপ্ত তারাই নামে মাত্র ইয়াজিদি মুসলমান। তাদেরকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে হবে। মেয়র বলেন, সুন্নিয়ত ও সুন্নিদের বিরুদ্ধে একটি অশুভ চক্র বিশ্বব্যাপী সক্রিয় রয়েছে। তাদের টার্গেট আজ আমাদের এই প্রিয় স্বদেশ। তাদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কারবালা মাহফিল আয়োজনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন জমিয়তুল ফালাহর খতিব আল্লামা সৈয়দ আবু তালেব মুহাম্মদ আলাউদ্দিন আলকাদেরী। তিনি হাদিস শরিফ ও ইমাম গাজ্জালির কিমিয়ায়ে সায়াদাতের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলেন, যারা মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না, তারা প্রকারান্তরে আল্লাহর প্রতিও অকৃতজ্ঞ। জমিয়তুল ফালাহর এ কারবালা মাহফিলের প্রতিষ্ঠাতা খতিবে বাঙাল অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ) এর অসামান্য দ্বীনি খেদমতের কথা মুসলিম মিল্লাত ও সুন্নি জনতা স্মরণ রাখবে। বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের বদান্যতায় এই মাহফিল আজ দিন দিন উজ্জ্বলতর হচ্ছে। কারবালা পরবর্তী পাপিষ্ট ইয়াজিদের অপকর্ম বিষয়ে আলোচনা করেন, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অধ্যক্ষ আল্লামা ড. এ কে এম মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, শুধু দাড়ি টুপির নাম ইসলাম নয়। ইয়াজিদের তাঁবুতেও ওই পাপিষ্টরা নামাজ পড়েছে। কিন্তু তাদের নামাজে আহলে বায়তে রাসুলের (দ) স্মরণ না থাকায় এই নামাজ আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আজকের নব্য ইয়াজিদিদের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। কোরআন মজিদ থেকে তেলাওয়াত করেন বিশ্বনন্দিত কারী শায়খ আহমদ নায়না (মিশর) ও আহমদ বিন ইউসুফ আল আজহারী। ধন্যবাদ বক্তব্য দেন, মাহফিলের প্রধান সমন্বয়কারী আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী হোসেন সোহাগ। তিনি বলেন, আমরা জোর পূর্বক কোনো কিছুই দখল করিনা। মানুষের মন জয়ী করেই এই মাহফিল জারি রেখেছি। তিনি সমবেত জনতা ও অতিথি-আলোচকদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। মাহফিল সঞ্চালনায় ছিলেন ড. মাওলানা জাফর উল্লাহ।
মাহফিলে অতিথি ছিলেন, সাংবাদিক আবু সুফিয়ান, আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরীর (রহ) সন্তান ব্যারিস্টার আবু সাঈদ মুহাম্মদ কাশেম ও আবু সাঈদ মুহাম্মদ হামেদ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার উপাধ্যক্ষ ড. মাওলানা আবু তৈয়ব মুহাম্মদ লেয়াকত আলী, বিজিএমএ এর সাবেক সভাপতি এস.এম. আবু তৈয়ব। শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা পর্ষদের কর্মকর্তা ও সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, মাহফিলের প্রধান সমন্বয়কারী আলহাজ্ব মুহাম্মদ আলী হোসেন সোহাগ, মুহাম্মদ খোরশেদুর রহমান, মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মুহাম্মদ সিরাজুল মোস্তফা, মুহাম্মদ ইসকান্দর আলম, অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমদ, মুহাম্মদ আব্দুল হাই মাসুম, মোহাম্মদ দিলশাদ আহমদ, মুহাম্মদ আবুল মনসুর সিকদার, হাফেজ মুহাম্মদ ছালামত উল্লাহ, জাফর আহমদ সাওদাগর, মুহাম্মদ সাইফুদ্দিন, এস এম সফি, আলহাজ্ব ইদ্রিস চেয়ারম্যান, মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম, খোরশেদ আলী চৌধুরী, মাঈনুদ্দিন মিটু, মুহাম্মদ শরফুদ্দিন প্রমুখ। এছাড়াও বিভিন্ন দরবারের সাজ্জাদানশিন ও মতোয়াল্লিবৃন্দ, বিভিন্ন মাদরাসার অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ, বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও খতিববৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মিলাদ কিয়াম শেষে দেশ ও বিশ্ববাসীর শান্তি-সমৃদ্ধি-কল্যাণ এবং বিশ্বের মজলুম মানবতার পরিত্রাণ কামনায় মুনাজাত করা হয়। প্রতিদিন সুফি টিভি ইউটিউব ফেসবুকে মাহফিল সরাসরি লাইভ দেখানো হচ্ছে। মসজিদের নিচতলায় পর্দা সহকারে মহিলাদের জন্য আলোচনা শোনার ব্যবস্থা ছিল।