চার হোঁচটে ধান
আবহাওয়ার বৈরিতা, সারের স্বল্পতা, ডিজেলের উচ্চমূল্য এবং কৃষিকাজের বর্ধিত খরচে দেশের কৃষকরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এসব সংকটের কারণে খাদ্য উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এবার বৃষ্টি কম হলে কৃষির ঐতিহ্যবাহী ছন্দ বিচ্যুত হতে পারে। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় কৃষকরা অসহায়। গত বোরো মৌসুমে বন্যায় ফসলহানির পর এই ভরা বর্ষা মৌসুমেও চাষাবাদের ক্ষেতগুলো খরার মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সার, ডিজেলসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্যের প্রভাব। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
চলমান আমন চাষে প্রথমে হোঁচট খেয়েছেন কৃষকরা। আসন্ন বোরো মৌসুমেও ডিজেলের বর্তমান দাম বহাল থাকলে ধান উৎপাদন খরচ বহুগুণ বেড়ে যাবে। এতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আগামী ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মধ্যে ভোক্তা পর্যায়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দুর্যোগ ঠেকাতে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
৪১ বছরে সর্বনিম্ন বৃষ্টি: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়ার মেজাজ বারবার বদলে যাচ্ছে। খরা, অত্যধিক ও অসময়ে বৃষ্টি, প্রচণ্ড ঠান্ডা বা তাপপ্রবাহ কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। অদ্ভুত এক বর্ষা দেখেছে এদেশ। পূর্ণ বর্ষায়ও বয়ে গেছে তাপপ্রবাহ। জুলাই মাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও এ বছর গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে অর্ধেকেরও কম। যার প্রভাব কৃষকদের মধ্যে পড়েছে।
এই জুলাই মাসে গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২১১ মিলিমিটার (মিমি), যা ১৯৮১ সালের পর সর্বনিম্ন, আবহাওয়া অফিস অনুসারে। আবহাওয়াবিদ মোঃ আব্দুল মান্নান জানান, গত ৪১ বছরের মধ্যে এই জুলাই মাসে দেশে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। গত জুনেও একই অবস্থা ছিল। জুলাইয়ের পর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় আগস্ট মাসে। তবে এ মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হচ্ছে।
দেশের প্রধান খাদ্যশস্য বিশেষ করে আমনের কিছু জাতের ধানের ফলন বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় দেশের ধান উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। বৃষ্টি কম হওয়ায় অতিরিক্ত পানি দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষককে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৮ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি আবাদ হয়েছে ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময় সরকারের মতে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসে না। প্রকৃত চাষের হার ৫০ শতাংশের বেশি নয়।
পরিবর্তনশীল কৃষি ক্যালেন্ডার: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফসল রোপণের সময়সূচিতে দেখা যায়, আমন মৌসুম জুলাইয়ের শুরু থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি। আমন ধান রোপণের সময় জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে আমন রোপণ করা গেলে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সরিষার সঙ্গে রবি বীজ রোপণ করা যেতে পারে। বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করতে হবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এবং চারা রোপণ করতে হবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এবার আমন আবাদে এক মাসেরও বেশি দেরি হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি হলেও ধান লাগাতে পারেননি অনেক কৃষক। অনেক বীজতলা শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। আমন ধান পাকতে দেরি হলে আলু, সয়াবিন, সরিষা ও রেপসিড দেরি হবে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাচ্ছে না। ধান ও জলাতঙ্কের চক্র ব্যাহত হলে গ্রামীণ অর্থনীতি ব্যাহত হতে পারে।
আমন-বোরোতে বাড়ছে খরচ : আমন মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকদের সেচের জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত দামের সঙ্গে সার সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ডিজেল ও কেরোসিন ছাড়াও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব ইতিমধ্যেই নিত্যপণ্যের বাজারে পড়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে সেচ মেশিন ছিল ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৩টি। এর মধ্যে ডিজেলে চলছে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৭টি সেচ মেশিন। অর্থাৎ প্রায় ৭৮.৪৩ শতাংশ সেচ ব্যবস্থা ডিজেলে চলে। এ ছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি ও পরিবহনে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এ হিসাবে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যবহার হয়েছে ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৯ টন ডিজেল। এই তেল কিনতে কৃষকদের খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। নতুন দামে আগামী বোরো মৌসুমে একই পরিমাণ ডিজেল ব্যবহার করলে কৃষককে দিতে হবে ১১ হাজার ১২১ কোটি টাকা। ফলে সেচ, পরিবহন ও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের অতিরিক্ত ৩০০৪ কোটি টাকা খরচ করতে হবে।
এছাড়া প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ৬ টাকা বাড়ানোর ফলে চলতি আমন ও আগামী বোরো মৌসুমে কৃষকদের চালের দাম ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বাড়বে বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।