বিবিধ

চাকরিটাই জাদুর কাঠি।বিআরটিএর  আন্দরমহল (১)

যেখানেই জমি বা ফ্ল্যাট কেনা-বেচা হাওয়া সেখানেই ছুটে বেড়ান জলিল মিয়া। একবার এটি পছন্দ করলে, দাম তার জন্য একটি সমস্যা ব্যাপার। তিনি একজন বড় সরকারি কর্মকর্তা। পাবনার ফরিদপুরের বেরহাউলিয়া গ্রামের কৃষকের ছেলে আব্দুল জলিল মিয়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বরগুনা সার্কেলের সহকারী পরিচালক। সহকর্মীদের মন্তব্য, তিনি ‘টাকার কুমির’! রাজধানীতে তার বেশ কিছু বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও গাড়ি রয়েছে।

টাঙ্গাইল বিআরটিএর আরেক সহকারী পরিচালক আলতাফ হোসেন। তিনি জলিল মিয়ার শ্যালক। দুলাভাই জলিল শিখিয়েছেন ‘আলগা কামাই’ প্রবাহ! এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। দুলাভাইয়ের মতো তিনিও ‘মানি মেশিন’ হয়ে গেলেন।

রাজধানীর মিরপুরে বিআরটিএর কার্যালয়ের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি হোমিওপ্যাথি কলেজ, ভাসানটেক থেকে ডিগ্রি লাভ করেন এবং নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ যোগ করেন। মিরপুর এলাকায় তার পরিচিতি ডা. আসাদুজ্জামান! সরকারি চাকরি করে গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক।

মিরপুর অফিসের হিসাবরক্ষক খান মোঃ রুহুল আমিন প্রায় ১৩ বছর ধরে একই চাকরি করছেন। বাড়ি, গাড়ি, জমি—কিছুরই অভাব নেই। গ্রামের দরিদ্র আত্মীয়রা দুই হাতেই টাকা হারিয়েছে। তাই গ্রামের মানুষের বিশ্বাস- রুহুল রাজধানীর ‘টাকার মাইনে’ কাজ করেন।

বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের অফিস সহকারী রজব আলী মোল্লা, যিনি সদ্য অবসর-পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন, তিনিও ঘুষ খেতে কম যাননি। মিরপুর অফিসে রেকর্ড রুমে থাকা অবস্থায় তিনি টাকা ছাড়া কাগজপত্র চিনতে পারেননি। রাজধানীর পূর্ব কাজীপাড়ায় পাঁচ একর জমিতে ছয়তলা বাড়িটির নাম ‘মোল্লা ভিলা’।

এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদই বলে দেয় বিআরটিএর ঘুষের পরিমাণ। বিআরটিএ শুধু ঢাকার প্রধান কার্যালয় নয়, মাঠপর্যায়েও সেবা ব্যবহারকারীদের হয়রানি, ভোগান্তি ও ভয়ের নাম। বলা হয়, অফিসের টেবিল-চেয়ারে ঘুষ ছাড়া আর কিছু জানে না! সরকারি পারিশ্রমিকের বাইরে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সব কাজ সহজে করা যায়। তা না হলে জুতার তলায় সমস্যার সমাধান হয় না। বিআরটিএর ‘আঙুলে পুষ্প’ কর্মচারীরা বিপুল সম্পদের সন্ধানে ছিলেন। তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়মের ভিত্তিতে অবৈধ সম্পদ অর্জনের শীর্ষে পৌঁছেছেন। বিআরটিএ চাকরি তাদের জন্য একটি ‘জাদুর কাঠি’। নইলে সরকারি চাকরির সামান্য বেতনে বেনামে এত সম্পদের মালিক হওয়া অবিশ্বাস্য।

বিআরটিএ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বলে বিশ্লেষকরাও বলছেন- এটা কমবেশি সবাই জানে। সেখানে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিপুল সম্পত্তির মালিক হবেন- এটাই স্বাভাবিক।

সহকারী পরিচালক আব্দুল জলিল মিয়া ১৯৮৯ সালে যান্ত্রিক সহকারী হিসেবে বিআরটিএতে যোগদান করেন। এরপর ২০০৮ সালে তিনি মোটরযান পরিদর্শক হন। সেখান থেকে বছর দুয়েক আগে সহকারী পরিচালক হন। এখন তার বেতন ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকার মধ্যে। মোটরযান পরিদর্শক থাকাকালে বেতন ছিল ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। সেই থেকে তিনি গাড়ি চালান, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বেশ কয়েকটি বাড়ি তৈরি করেন। তবে তার বেশিরভাগ সম্পদই তার স্ত্রী মাহমুদা নাসরিনের নামে।

অনুসন্ধানে ঢাকায় তিনটি বাড়ি, চারটি ফ্ল্যাট, একটি প্লট ও একটি প্রাইভেটকার পাওয়া গেছে। গ্রামে জলিলের বাবার ছয়-সাত বিঘা জমি ছিল। সে জমি চাষ করে সংসার চালাতেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে জলিল মিয়া দ্বিতীয়। বিআরটিএতে যোগদানের পর জলিলের জীবন বদলে যায়। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন। জলিলের ছোট ভাই সাচ্চুও মিরপুর অফিসের দালাল। কিন্তু দুই ভাইয়ের সম্পর্ক এখন দা-কুমরো!

মিরপুর অফিসের উল্টো দিকে কয়েকশ গজ দূরে তার বিলাসবহুল বাড়ি। মোটরযান পরিদর্শক থাকাকালীন তিনি কাফরুলের ১৩ নম্বর সেকশন এ ব্লকের ১০/১ নম্বর লেনে একটি সাততলা বাড়ি তৈরি করেন। হোল্ডিং নং ০২/০১। প্রতি ফ্লোরে দুটি ফ্ল্যাট। তবে তৃতীয় তলায় দুটি ইউনিটে পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকেন জলিল। তার বেকার ছেলে নাজমুল হাসান নাঈমের স্ত্রী চার তলার ফ্ল্যাটে থাকেন। অন্য সব ফ্ল্যাট ভাড়াটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জলিল মিয়া সম্প্রতি বাড়ির পাশে একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবনে (৫৩, ৫৪, ৫৫ নম্বর প্লট) সাড়ে চার কোটি টাকায় চারটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। পুরো টাকা পরিশোধ করা হলেও এখনো ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। ২৯ মে ওই ভবনে গিয়ে নির্মাণের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলি। তিনি বলেন, তিনটি প্লট একত্রিত করে একটি ভবন করা হচ্ছে। জলিল মিয়া অষ্টম ও দ্বিতীয় তলায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাকি দুটি ফ্ল্যাটের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারেননি তিনি।