চট্টগ্রামের হকার্স লীগ নেতা রিপন হত্যা। ১৬ লাখ টাকার ‘খেলায়’ পাল্টে গেল বাদীর বয়ান।
তদন্ত শেষে বাদী নিজে খুনের মামলার ১ ও ২ নম্বর আসামিকে মামলা থেকে অপসারণের জন্য আদালতে আবেদন করেন। বাদী তাদের নির্দেশনা ও পরিকল্পনার আওতায় খুনের অভিযোগ এনে যারা মামলার মূল আসামী করেছিলেন বছর না ঘুরতেই তাদেরই নির্দোষ সাটির্ফিকেট দিলেন। খুনের মামলায় বাদীর জবানবন্দির পরিবর্তনের পেছনে ১৬ লাখ টাকার ‘খেলা’ লেনদেনের এক মর্মান্তিক তথ্য উঠে এসেছে। আর এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের ক্রাইম জোনের শেরশাহ এলাকার হকার্স লিগের নেতা রিপন মার্ডারের ঘটনায়। রিপনের স্ত্রীকে খুন করা এমন এক বিস্ময়কর কাজ দেখে বাদীর চোখ আরও প্রশস্ত হয়। যদিও বাদী তার বক্তব্য বদলেছে, ভুক্তভোগীর স্বামী হত্যা মামলার ১ ও ২ নম্বর আসামিকে বাঁচানোর চেষ্টা করায় কাঠগড়ায় তুললেন খোদ বাদীকেও।
রিপনের স্ত্রী রাশেদা বেগম বলেন, আমার স্বামী রিপন হত্যা মামলার বাদী মোঃ আজাদ আমার স্বামীর সৎ ভাই। ঘটনার পরে আমরা তাকে বিশ্বাস করে তাকে বাদী করেছিলাম। তবে আমি ভাবতেও পারি না যে মামলার তদন্তের সময় বাদী আমাকে পিঠে ছুরিকাঘাত করবে। মামলার দুই প্রধান আসামির কাছ থেকে বাদী ১৬ লাখ টাকা নিয়ে তাদের বাঁচাতে ছুটে যায়। বাদী আসামীকে মামলা থেকে বাদ দিতে আদালতে আবেদন করেন তা নজিরবিহীন। বাদী আজাদ আমার কাছে স্বীকারও করেছেন যে তিনি অভিযুক্তের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তাই আমি আমার স্বামীর হত্যার মামলায় বাদী বদলানোর জন্য শীঘ্রই আদালতে আবেদন করব।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক মো: নাজমুল বলেন, আমি কিছুদিন আগে মামলার তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছি। তবে আমি শুনেছি যে আসামীদের কয়েকজনের নাম মুছে ফেলার জন্য বাদী আদালতে আবেদন করেন। তদন্তে কাউকে জড়িত থেকে ছাড় দেওয়া হবে না। এর আগে তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর হাসান ইমাম বলেন, “এটা আমার কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছিল যে বাদী, যাদের বিরুদ্ধে হলফনামায় খুনের অভিযোগ আনা হয়, তারা কয়েক দিন পরে মামলা থেকে অপসারণের জন্য আবেদন করেন।
রিপন হত্যার সময় আর এক ভুক্তভোগী গুরুতর আহত হন এবং মামলার সাক্ষী ছিলেন। আলামিন জানান, মামলা দায়েরের পরে বাদী সাত থেকে আট মাস ঠিক ছিলেন। তারপরে তার আচরণ বদলাতে শুরু করে। আমি এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম এবং রিপনের সাথে আমাকেও খুন করার জন্য কোপানো হয়। তবে বাদী আজাদ আসামিদের সাথে আঁতাত করে মামলাটি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেন।
বাদী মো: আজাদ বলেন, “আমার সৎ ভাইকে হত্যার পরে দেখে মনে হয়েছিল যে দিদার ও মহিউদ্দিন তাকে পরিকল্পনা করে হত্যা করেছিল।” আমি পরে জানতে পারি যে তারা এই ঘটনায় জড়িত ছিল না। তাই আমি মামলার অভিযোগপত্র থেকে তাদের নাম সরিয়ে দেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছি। এক প্রশ্নের জবাবে বাদী আজাদ বলেন যে অভিযুক্তরা পলাতক হলেও তারা আমার সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছিল। তারা নির্দোষ, তিনি বলেন। ১৬ লাখ টাকা দিয়ে অভিযুক্তের নাম সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়, এটি মিথ্যা।
জানা গেছে, মামলার মূল দুই আসামি দিদার ও মহিউদ্দিন হত্যার পরে পালিয়ে গেছে। তারা প্রথমে ভারতে পালিয়ে গেলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় চট্টগ্রামে ফিরে আসে। তারা শেরশাহ এলাকায় ফিরে না এলেও তারা শহরের জামালখান এলাকায় অবস্থান করছেন। চট্টগ্রামে ফিরে এসে মূল আসামিরা বাদী পরিচালনার মিশনে গিয়েছিল। তারা মামলার বাদী আজাদের সাথে দু’বার জামালখানের একটি রেস্তোঁরায় সাক্ষাত করেছেন। তার মতে আসামি বাদীকে তিন কিস্তিতে ১৬ লাখ টাকা দিয়েছেন। বাদী শেরশাহ এলাকায় রাস্তার পাশে ফলের ব্যবসা করত তবে এখন তাকে ফলের ব্যবসায় দেখা যায় না। ভিকটিম রিপনের স্বজনদের মতে, বাদী বাড়িতে নতুন দামি আসবাবও নিয়ে আসে।
২০১৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর রাতে হকার্স লীগ নেতা রিপনকে হত্যার পর তার সৎ ভাই মোঃ আজাদ শহরের বায়েজিদ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। দিদারুল আলম দিদারকে ১নম্বর ও এএম মহিউদ্দিনকে ২ নম্বরদিয়ে ২৮ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। রিপনকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ঘটনাস্থলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত রিপনের সহযোগী আলামিনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে ভর্তি করা হয়। বায়েজিদ পুলিশ ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল হৃদয় এবং ইয়াসিন সামিকে গ্রেপ্তার করে। অভিযুক্ত হৃদয় তখন পুলিশ ও আদালতে সাক্ষ্য দেন। তার জবানবন্দিতে আসামি হৃদয়কে বলেন যে শেরশাহ এলাকায় যুবলীগ কর্মী রিপনকে হত্যার জন্য ৯ সন্ত্রাসী সরাসরি অংশ নিয়েছিল। রিপনকে উঠতি সন্ত্রাসী ইসলাম রাজু ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। রিপনকে ছুরিকাঘাতের আগে নীল বাড়ির সামনে সন্ত্রাসীরা মানিক, বোমা খোকন, পারভেজ, সানি, রাব্বি, জাহাঙ্গীর, আশিকুর ও মমিনকে নির্মমভাবে মারধর করে। এ ঘটনার পর পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এমদাদ নামে এক সন্ত্রাসী নিহত হযন।
এখন পর্যন্ত এ মামলায় কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া পাঁচ আসামি গ্রেপ্তার হলেও মামলার প্রধান আসামি দিদার ও মহিউদ্দিনর ধরাছোয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।