• বাংলা
  • English
  • জাতীয়

    গণপিটুনির ফাঁদে প্রাণনাশ

    শরীয়তপুরে গত শুক্রবার রাতে চারজনকে পিটিয়ে হত্যার রেশ না কাটতেই সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনিতে দুজনকে হত্যা করা হয়। পরের দিন মঙ্গলবার রাজধানীর ভাটারায় ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে মব সৃষ্টি করে পেটানো হয় দুই ইরানি নাগরিককে। একই রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি বাসায় ২০০-৩০০ কোটি টাকা থাকার খবর রটিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় একদল দুর্বৃত্ত। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চাতুর্যতার সঙ্গে ‘মব’ তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে হত্যা, লুটপাটে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘বিক্ষুদ্ধ জনতা’র ‘গণপিটুনি’ ফাঁদ। গত ছয় মাসে গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। এমন কা-ের অধিকাংশই ঘটছে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে। ভুক্তভোগী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

    অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। চুরি ডাকাতির মতো অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় না। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র। গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এমন ফাঁদে পড়ে নিরপরাধ মানুষও মারধর ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। তারা বলেছেন, এহেন অপরাধে জড়িতদের কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এসব কাজে জড়িত থাকলে দল থেকে বহিষ্কারসহ নির্মোহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই গণপিটুনির মতো ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

    মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গণপিটুনিতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ২৯। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাস আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১১২ জন। সেই হিসাবে গণপিটুনির নামে প্রতি ৩৮ ঘণ্টায় একজনকে হত্যা করা হচ্ছে।

    পরিসংখ্যান বলছে, পটপরিবর্তনের মাস আগস্টে গণপিটুনিতে মারা যায় ২১ জন। পরের মাস সেপ্টেম্বরে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় ২৮ জনের, যা ২০২১ সালের পুরো বছরের সমান। গত বছরের অক্টোবরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১৯ জন, নভেম্বরে ১৪ জন ও ডিসেম্বরে ১৪ জন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গণপিটুনিতে নিহত হন ১৬ জন।

    আসকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫৭ জন, রাজশাহীতে ১৯ জন ও চট্টগ্রামে ১৭ জন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৫১ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন এবং ২০২০ সালে ৩৫ জন।

    গত সোমবার দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নেজাম উদ্দিন ও আবু সালেককে পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। গত সোমবার রাতে কাঞ্চনার পাশের এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা চূড়ামনি গ্রামে ‘ডাকাত’ আখ্যা দিয়ে এ দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সাতকানিয়া থানার ওসি জাহেদুল ইসলাম জানান, নিহতরা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে ছনখোলা চূড়ামনি গ্রামে গেলে মাইকে ডাকাত ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর এলাকাবাসী তাদের ঘিরে গণপিটুনি দিলে দুজনের মৃত্যু হয়।

    নিহত নেজাম ও সালেককে নিজেদের কর্মী দাবি করে জামায়াতে ইসলামী কাঞ্চনা ইউনিয়নের সেক্রেটারি জায়েদ হোসেন বলেন, পরিকল্পিতভাবে তাদের সালিশি বিচারের নামে ‘ফন্দি’ করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে মারধর করে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর মাইকে ডাকাত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মারধরকারীরা ঘটনাস্থলে কাউকে যেতে দেয়নি। এমনকি সড়কে গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছিল।

    গত শুক্রবার রাতে একদল ডাকাত মাদারীপুরের রাজারচরে বাল্কহেডে ডাকাতির চেষ্টাকালে নৌযান শ্রমিক ও স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া দেয়। একপর্যায়ে ডাকাতরা গুলি ছুড়ে স্পিডবোটে পালানোর চেষ্টা করে। পরে তারা শরীয়তপুরের ডোমসার এলাকায় ধরা পড়ে। গণপিটুনিতে সাতজন আহত হয়। আহত ডাকাতদের হাসপাতালে নেওয়া হলে দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়। কীর্তিনাশা নদী থেকে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

    সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে আহত করার পর পায়ে দড়ি বেঁধে পদচারী সেতুর সঙ্গে তাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। টঙ্গীতে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। বাদ যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘মব’ সৃষ্টি করে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ইউসুফ আলীকে হেনস্তা ও মারধর করা হয়। ভুয়া পুলিশ অভিযোগ দিয়ে মব সৃষ্টি করে পুলিশ সদস্যের মুঠোফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

    এর আগে আদালত প্রাঙ্গণে মারধরের শিকার হন সাবেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে বিচারপতি। হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের দপ্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই গণপিটুনির শিকার হন উৎসব মণ্ডল নামে এক তরুণ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকেও সাম্প্রতিককালে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

    মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা বলেছেন, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্রকেই তুলে ধরে। আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার কারণে গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যায়। দিনের পর দিন এসব বৃদ্ধি পেলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে না নেওয়ায় ঘটনা আরও বাড়ছে। আর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে প্রতিপক্ষকে ফাঁদে ফেলে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। গণপিটুনি আইনের দৃষ্টিতে ‘হত্যা’ এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হত্যাকারী।

    ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা তৈরি হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটছে। তবে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে আমরা যে বাংলাদেশ চাই, সেটায় সব অপরাধের বিচার একটা আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

    এই সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় আইন হাতে তুলে নেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের কঠোর বার্তা দিতে হবে। গণপিটুনির মতো অপরাধে অংশ নিলে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো নেতাকর্মীদের বহিষ্কারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।

    গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফেসবুককেন্দ্রিক অপপ্রচারের মাধ্যমেও গণপিটুনির মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এতে করে অনেকেই মনে করছেন, তারা নিজেরাই বিচার করবেন। এটা অশনি সংকেত।

    সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গণপিটুনির বড় অংশের পেছনে মতলববাজ বা সুযোগ সন্ধানীরা থাকেন। দুই-চারজন মিলে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করলে নির্ণয় করা সম্ভব, কার পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শত শত লোক যখন গণপিটুনিতে অংশ নেয়, তখন প্রকৃত অপরাধী নির্ণয় করা কঠিন। ফলে যে কোনো নির্বাচনের আগে বা কোনো বিশেষ সময়ে গুজব রটিয়ে বা অন্য কোনো কারণে গণপিটুনি বেড়ে যায়। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরেও গণপিটুনিতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছিল। একইভাবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গণপিটুনিতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।

    পুরান ঢাকায় বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, একই ভবনের একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দার সঙ্গে তার পরিবারের মনোমালিন্য ছিল। গতকাল বুধবার সকালে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এ সময় হঠাৎ তার প্রতিবেশী ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার করে উঠেন। আশপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে আসেন। ঘটনাস্থলে এসে বুঝতে পারেন, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে ডাকাতি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ভবনের বাসিন্দারা ভালোভাবে না চিনলে গণপিটুনি দিয়ে আমাকে তারা মেরেও ফেলতে পারত। তিনি বলেন, ছিনতাই ডাকাতির মতো অপরাধকে যারা প্রতিপক্ষ ঘায়েলের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

    ভুক্তভোগীরা বলেছেন, গণপিটুনির ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও বিচার হওয়ার নজির কম। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে ঢাকার পাশেই আমিন বাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকা-ের ১০ বছর পর আদালত ১৩ জনকে মৃত্যুদ- এবং ১৯ জনকে কারাদ-ের আদেশ দেন। কিন্তু এখনও মামলাটি আপিল আদালতে ঝুলে আছে। বিচার না হওয়ায় কিংবা রায় কার্যকর না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধের বিষয়ে মানুষের মধ্যে সতর্কতা কাজ করছে না।

    দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক গণপিটুনিকাণ্ডে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রাস্তায় চলাচলে আতঙ্ক বাড়ছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী সালেহ রহমান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, রাস্তায় চলাচলে ভয় লাগে। পূর্ব শত্রুতার জেরে কয়েকজন মিলে যদি ছিনতাইকারী বলে পেটানো শুরু করে, তাহলে অন্যরা কোনো ধরনের বাছবিচার না করেই পেটানো শুরু করবে। গণপিটুনিতে তো বিচারের নজির নেই। ফলে খুনিরাও পার পেয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় চলাচল করাই কঠিন হয়ে পড়বে।

    Do Follow: greenbanglaonline24