জাতীয়

খেলা হবে বাহাসে সংঘাতের আলামত

রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সহিংসতা বাড়ছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সাধারণ সভাকে ঘিরে এই পরিস্থিতি আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘খেলা হবে’ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতারাও ‘প্রতিশোধ’ ও পরিস্থিতির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ক্রমশ সূক্ষ্ম হয়ে উঠছে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কিন্তু চলমান সংঘর্ষ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা একে অপরকে হুমকি দিচ্ছেন, উত্তপ্ত বক্তৃতা প্রায়ই রাস্তায় কর্মী-পুলিশের সংঘর্ষে ইন্ধন যোগাচ্ছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সহিংসতা যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি নেতাদেরও সংযত করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত জুলাইয়ের শেষ দিক থেকেই রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হয়েছে। জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বিএনপি ও তার মিত্ররা গণসমাবেশ শুরু করে। আওয়ামী লীগ নেতারাও বসে না থাকার ঘোষণা দিয়ে কঠোর হাতে আন্দোলন প্রতিহত করার কথা বলে আসছেন।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ইস্যুতে গত ২৯ জুলাই থেকে বিএনপি বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশও হস্তক্ষেপ করে। আগস্টের শেষ তিন সপ্তাহে অন্তত তিনজন বিএনপি কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছেন। নেতাদের ডাকে হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে রাস্তায় নামেন বিএনপি কর্মীরা। ১২ অক্টোবর, বিএনপি যখন চট্টগ্রাম থেকে ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি শুরু করেছিল, তখন প্রতিটি সমাবেশের আগে দৃশ্যত সমাবেশ সীমিত করার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে বাস লঞ্চসহ মোটরচালিত গণপরিবহনে ‘হরতাল’ ডাকলে জনমনে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দেয়। . মালিক-শ্রমিকদের হরতাল ডাকার কথা থাকলেও সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জনগণ। একই পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর ও সিলেটে বিএনপির জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পারস্পরিক বিরোধিতা এবং মৌখিক বিস্ফোরণ সত্ত্বেও, উভয় পক্ষের সংযমের ফলে কোনও বড় ধরনের সহিংসতা ঘটেনি, তবে জনমনে অস্বস্তি ও শঙ্কা রয়েছে। ২৬ নভেম্বর খুলনায় ও ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে গণসমাবেশের পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শেষ হবে।

ঢাকা মহানগরীর আগে ও পরে ঢাকা মহানগরীতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। এরই মধ্যে ১১ নভেম্বর যুবলীগের যুব সম্মেলন, ২৯ অক্টোবর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন এবং রবিবার উত্তরা ছাড়াও রাজধানীতে অন্যান্য শান্তি সমাবেশে বিপুল জনসমাগম করে তারা নিজেদের শক্তির পরিচয় দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে রাজপথ দখলের ঘোষণা দেওয়ায় আগামী দিনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও এর সরকারের আরও উদারতা দেখানো উচিত। সরকার সমর্থক পরিবহন সংগঠনগুলোকে নিয়ে ‘পরিকল্পিত’ পরিবহন ধর্মঘট ডেকে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে বাধা দেওয়ার সংস্কৃতি পরিত্যাগ করতে হবে। বিএনপিকেও সহনশীলতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের দিকে নজর দিতে হবে।

বিএনপির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত ৯২টি স্থানে দলীয় কর্মসূচিতে সরকার সমর্থক ও পুলিশ হামলা চালিয়েছে। এতে তিনজন নিহত হয়েছেন। ২০ থেকে ২৫ জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ৭২টি মামলা হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মী। গ্রেপ্তার করা হয় চার শতাধিক। প্রায় ২৫,০০০অজ্ঞাত আসামি রয়েছে। এরপরও গত কয়েক দিনে রাজধানীর পল্লবী, বনানী ও মুন্সীগঞ্জে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের গুলিতে স্থানীয় ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছেন।

তবে আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নেতাকর্মীদের উসকানির কারণে কোথাও কোথাও সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সন্ত্রাস ও সহিংসতা মোকাবেলায় পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বর্তমান সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান উপায় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি গণতান্ত্রিক আচরণ এবং পরম সহনশীলতা দেখানো। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে সকলেরই সম্মান করা উচিত।

মন্তব্য করুন