খরার কবলে দেশ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর স্বাভাবিক চক্রের পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কয়েক বছর ধরে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মিছিলে যোগ দিয়েছে খরা। ভরা বর্ষায় বৃষ্টি নেই, বৃষ্টিতে মাঠ ফেটে যাচ্ছে। কৃষিতে এর বড় প্রভাব পড়ছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর খরার কারণে প্রায় ৩৫ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি নষ্ট হচ্ছে। অর্থের দিক থেকে তা ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরম তাপমাত্রা, জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া, বন উজাড় এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তবে আগামী দিনে আরও খরা অপেক্ষা করছে বলেও সতর্ক করেছেন আবহাওয়াবিদরা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের খরার প্রভাব আগামী ৫০ বছরে দক্ষিণ ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
পূর্ণ বর্ষায়ও বৃষ্টি হয় না
বর্ষা এখন ক্যালেন্ডারে। আষাঢ়ের শেষে শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ পার করুন। কিন্তু আকাশে মেঘ নেই, বাতাস বইছে না। ঋতুর নিয়ম ভেঙে আকাশ এখন শরতের মতো সাদা। সূর্য তাপ দিচ্ছে। গতকাল ও শনিবারও রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, কিশোরগঞ্জে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই গরম থাকবে। তাপমাত্রা অনেক সময় কম হতে পারে, কিন্তু তাপের অনুভূতি কম হবে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এখন বাতাসে জলীয় বাষ্পের মাত্রা বেশি, বৃষ্টি কমেছে। এখন তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলেও আর্দ্রতার কারণে তাপ বেশি অনুভূত হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মনোয়ার হোসেন বলেন, জুলাই মাসের প্রথম ২০ দিনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। গত ৩০ বছরে জুলাই মাসে এত কম বৃষ্টিপাত হয়নি। ২০২২ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল এবং ২০২১ সালের জুলাই মাসে ৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪.১ শতাংশ কম এবং জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাপপ্রবাহের প্রভাবের ক্ষেত্রও পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর এমন বিরূপ প্রভাবের কারণে প্রকৃতির বিভিন্ন বৈরিতা যেমন শৈত্যপ্রবাহ, খরা ও অতিবৃষ্টি বা বৃষ্টিপাত না হওয়া এখন বাস্তবতা। এই প্রেক্ষাপটে খাল, নদী নালা, জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। শহর ও গ্রামে সবুজ বাড়াতে হবে। গ্রিনহাউস নির্গমন কমানো না হলে বিপদ অপেক্ষা করছে।
আমান আবাদ পুরোপুরি বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। চলতি বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানান, উৎপাদিত ধানের ৩৮ শতাংশই আসে আমন থেকে। এই বৃষ্টিনির্ভর ফসলটি শ্রাবণ মাসে (মধ্য-জুলাই-মধ্য-আগস্ট) রোপণ করা হয়। জুন থেকে বীজতলা প্রস্তুত। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আগস্ট মাসেও সারাদেশে একই ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। ফলে ঝুঁকিতে পড়তে পারে আমন উৎপাদন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে কয়েকটি জেলা প্রকৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তার মধ্যে সাতক্ষীরা অন্যতম। সাতক্ষীরায় গত তিন বছর ধরে যথাযথ বর্ষা না হওয়ায় বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে চারা চাষ তো দূরের কথা, অধিকাংশ কৃষক এখনো বীজতলা তৈরি করতে পারেননি। আশাশুনির বিছাট গ্রামের রুহুল আমিন মোড়ল বলেন, অনেক আগেই ধানের বীজ কিনে রেখেছি। বৃষ্টি না হওয়ায় আমরা এবার বীজতলা তৈরি করতে পারিনি।
এদিকে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে গ্রামের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরে পানি নেই। ফলে পাটের ফলন ভালো হলেও তা তোলা সম্ভব হচ্ছে না। সোনালি আঁশ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। তারা ক্ষেতে পাট ফেলেছে।
রাজশাহীতে টানা বৃষ্টি না হওয়ায় পবা উপজেলার বাগসারা এলাকায় কৃষকরা পাট কেটে মাটিতে ফেলে রেখেছেন- শরিফুল ইসলাম তোতা
ফরিদপুরের সালথার সোনাপুর ইউনিয়নের কৃষক খালেক মাতুবর জানান, তাকে পুকুর ভাড়া করে পাট তুলতে হয়। সোনালি আঁশ আমাদের গলায় ফাঁসের মতো।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, বোরোর পর সবচেয়ে বেশি ধান আসে আমন থেকে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখছে। বৃষ্টিনির্ভর আমনে সেচ খরচ বেড়েছে। সব ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়িয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। আমন উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়ার বিকল্প নেই। এ ছাড়া খরা সহনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করতে হবে।