ক্যাপাসিটি চার্জের লাগাম চায় অর্থ মন্ত্রণালয়।বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠিতে বিভিন্ন নির্দেশনা
বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ খাতের লোকসান রোধে বিদ্যুৎ বিভাগকে সক্ষমতা হার কমানো ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন বা নতুন চুক্তির আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগকে লেখা চিঠিতে ভর্তুকি অব্যাহতির শর্ত হিসেবে এসব নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। বিদ্যুৎ খাতের ক্রমবর্ধমান লোকসান নিয়ে সমালোচনা ও উদ্বেগের মধ্যেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান দিন দিন বাড়ছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এই লোকসান মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে ভর্তুকি দিতে হয়। কিন্তু লোকসান এতটাই বেশি যে পিডিবিকে বাজেটে বরাদ্দ ভর্তুকির চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে। গত ১২টি আর্থিক বছরে (২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২) বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। অন্যদিকে লোকসান সামাল দিতে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে আবারও বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৮-২৫ শতাংশ বাড়তে পারে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোক্তা পর্যায়েও দাম বাড়বে।
ক্রমবর্ধমান লোকসান ও ভর্তুকি: গত এক দশকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি লোকসানও বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৬,৬৩৯ মেগাওয়াট, এ বছর পিডিবি ৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তখন সরকার ৪০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ১০০ মেগাওয়াটে, পিডিবির লোকসান হয়েছে ৬ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা। সরকার ভর্তুকি দেয় ৬ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। এভাবে ২০২০-২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে ২১ হাজার ২৮০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়, সে সময় পিডিবির লোকসান হয়েছিল ১১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা ।ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২১ হাজার ৬৮০ মেগাওয়াট। চলতি অর্থবছরে পিডিবি রেকর্ড ২৯ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এই ভর্তুকির পুরো টাকা এখনো পায়নি পিডিবি।
ক্যাপাসিটি চার্জও বাড়ছে: বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়লেও চাহিদা সে অনুযায়ী বাড়েনি। এ ছাড়া রয়েছে জ্বালানি সংকট। তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধারণক্ষমতার একটি বড় অংশ উৎপাদনে নেই। বিদ্যুৎ না কেনা সত্ত্বেও, উদ্যোক্তাদের তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে কেন্দ্র ভাড়া হিসাবে পিডিবিকে ফি দিতে হয়, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৭১২ মেগাওয়াট। গড় উৎপাদন ১২ হাজার মেগাওয়াট। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ উৎপাদনের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে, সরকারকে প্রায় ৮৬,৬৭০ কোটি টাকা বেসরকারী কেন্দ্রগুলির জন্য সক্ষমতা চার্জ হিসাবে দিতে হয়েছে।
২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩১৬২ মেগাওয়াট। ক্ষমতার ৫৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়েছে। তখন পিডিবি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ২৭৮৩ কোটি টাকা দিয়েছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩ হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াট। ৫৮ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল রুপি। ৫০০০ কোটি টাকা। এভাবে প্রতি বছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়তে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫৩ শতাংশই উৎপাদনে ছিল। ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পিডিবির ব্যয় ছিল ৫,৩৭৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে, বেসরকারি খাতের ক্ষমতা ছিল ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। উৎপাদন ছিল ৪৬ শতাংশ। পিডিবি উদ্যোক্তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার ২১ কোটি টাকা দিয়েছে। এরপর গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫৩৪ মেগাওয়াটে। ৪৫ শতাংশ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এ সময়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৪ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে পিডিবি।
তবে প্রভাবশালীদের চাপে অর্থ মন্ত্রণালয় ক্যাপাসিটি চার্জ কমানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
চাহিদা না থাকলেও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ছে: পরিকল্পনা অনুযায়ী চাহিদা না বাড়লেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ছে। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণাধীন ২০টি প্ল্যান্ট থেকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে ১০,৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ১২টি বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।