কাউকে ফাঁসির মঞ্চে দেখলে মায়া হতো’
পাঁচ, দশ, উনিশ- টানা ৩২ বছর! লাল বিল্ডিং যন্ত্রণা আর বিলাপে ভরা। প্রাচীর পেরিয়ে অবশেষে নতুন জীবনে পা রেখে খোলা আকাশ দেখতে পেলেন। অন্ধকার ঠেলে তিনি যখন আলোতে আসেন, তখন রথের বয়স ৭৩। তিনি শাহজাহান ভূঁইয়া। দেশের বিখ্যাত জল্লাদ।
গতকাল রোববারের সকালটা তার মনে রাঙা হয়ে থাকবে চিরকাল। কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক থেকে বেরিয়ে আসেন ‘সাদা’ শার্ট-প্যান্ট পরে মনের গভীরে স্মৃতির ঝাঁপি নিয়ে। কোমরে কালো বেল্ট। জামাকাপড় বলে দিয়েছে জেলের জীবন কেমন কালো-সাদা।
শাহজাহানকে তার ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিনের সাজা থেকে ক্ষমা করা হয়। কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি আবেগঘন কণ্ঠে গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। দেখেন না, কেউ আমাকে নিতে আসেনি! কারাগারে কয়েকজন বন্দীর সাথে বন্ধুত্ব করেছেন। তাদের একজনের বাড়ি বারিধারা নর্দায়। রওনা দিলাম তার বাড়ির দিকে।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার আবেদন। আমার বাড়ি নেই। এত বছর জেলে থাকার পরও আমার কিছুই নেই। জেল থেকে বের হয়ে আমি নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না, আমি অন্যের বাড়িতে যাচ্ছি।এখন কি খাব?কোথায় যাব কি করব এখন কিছু করার বয়স নেই।প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাকে একটি বাড়ি ও চাকরি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তার কারাজীবনের অভিজ্ঞতার কথা জানান। কারাগারে ২৬ আসামিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি। চার যুদ্ধাপরাধী, দুই জেএমবি সদস্য এবং অন্যান্য বিতর্কিত মামলায় ১৪ জন। অনেক আসামি মৃত্যুর আগে শেষ কথা বলেছে। আসামীদের কেউ কেউ বলেছে যে তারা কোন অন্যায় করেনি, এবং কেউ কেউ মৃতদেহের ছবি তুলতে অস্বীকার করেছে। আরেক আসামি মৃত্যুর আগে সিগারেট খাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলাম। এ সময় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেয়েছি। আমাকে ভালবাসত এবং সম্মান করত।
বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হয়েছে- এটা কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই অনুভূতিটা আমার ভালো লাগছে।’
শাহজাহান বলেন, প্রতিটি ফাঁসির মধ্যেই কিছু আবেগ থাকে। একজন মানুষের জীবন আমার হাতে। মানুষ যাই করুক না কেন। মৃত্যুর মুখে পড়লে একটু মায়া হয়। আমার সেই মায়া ছিল না। কিন্তু আদালত ও আইন তা করবে না। যদিও মায়া লাগে, কাজ করতে হয়। অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন, কাউকে ফাঁসির মঞ্চে দেখাটা বড় মায়া।
ফাঁসির সময় আসামিদের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, “আমি যখন এরশাদ শিকদারকে ফাঁসি দিয়েছিলাম, তখন তিনি দাঁড়িয়ে কিছু বলছিলেন। আমি আমার জীবনে কোনো অন্যায় করিনি, আমার জন্য দোয়া করবেন। বাংলাভাই কিছু বলেননি। ফাঁসিতে ঝুলানোর আগে তিনি শুধু বলেছিলেন, মৃত্যুর পর কেউ যেন তার ছবি না তোলে।
ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কী বলেছিলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কিছু বলেনি। যুদ্ধাপরাধীরাও ফাঁসির আগে কথা বলতেন না। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমিন রীমা হত্যা মামলার আসামি মুনির ফাঁসির আগে বলেছিলেন, আমাকে একটা সিগারেট দাও, আমি খাব।
ফাঁসির আগে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, মানুষ যতই অস্থির হোক না কেন, সে যখন জানে যে আজ আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। তখন মুখ থেকে খারাপ কথা বের হয় না।
চুপচাপ থাকে। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন বলে জেনেছি। তবে ফাঁসির দিন তিনি কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেননি। সে বুঝে গেছে এখানে ঝগড়া করে লাভ নেই।’ ফাঁসির সময় সাকা চৌধুরীর মাথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘না, না তা হয়নি। এটা কখনই হয় না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় কারও মাথা কাটা হয় না, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। অভিযুক্তের উচ্চতা ও ওজন অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি অপরাধ করেছি। সে জন্য জেলে এসেছি, সাজা ভোগ করেছি। আপনি এখন আমাকে করুণা দেখাচ্ছেন – লোকটি এত বছর জেল খাটল। তুমি যদি আমার পিঠ টেনে দাও, তাহলে আমি অতীতে কেমন ছিলাম। এখন মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেওয়ার মতো অতীত সব ভুলে গেছি। এখন ভবিষ্যতে কীভাবে চালিয়ে যাব, সেটাই বিষয়।
নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার নির্দেশে ফাঁসি কার্যকর হয়নি। রাষ্ট্রের নির্দেশে আমি ফাঁসি দিয়েছি। বিচার প্রক্রিয়া শেষে আমি কারাগারে সাজা ভোগ করছি। তাই কারাবিধি অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। আমি সাহসী ছিলাম বলে আমাকে জল্লাদ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। এই কাজটি আমি না করলে অন্য কেউ করত।
শাহজাহানের মুক্তির আগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মানিকগঞ্জে দুটি মামলায় তাকে ৪২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাগারে ভাল কাজের জন্য ১০ বছর, ৫ মাস এবং ২৮ দিন মওকুফ (সাজা মওকুফ)। আর তিনি ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিনের সাজা ভোগ করেন। জল্লাদ শাহজাহান এ পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন। তার সাজা মওকুফ করা হয়েছে।