করোনার কারণে ঝরে পড়া শিশুরা আর স্কুলে ফেরেনি
প্রকৃতির প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। টানা দুই বছর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শিক্ষা খাতে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। কোভিড-১৯ এর বিস্তারের সময় এবং পরে শিক্ষার ঘাটতি মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে বাল্যবিবাহের শিকার এবং শ্রমঘন কাজের সঙ্গে জড়িত শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। ফলে ২০২০-২০২১ এবং ২০২২ সালে স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। টানা তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্কুল পর্যায়ে ঝরে পড়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে জেন্ডার সমতা অর্জনসহ শিক্ষার বিভিন্ন সূচক নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এটি দেখায় যে ২০২১ এবং ২০২২ সালে, প্রায় ৯৫০,০০০ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশু আর স্কুলে যাচ্ছে না। তাদের প্রায় সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, যাদের অর্ধেকই মেয়ে। করোনার সময়ে পারিবারিক আয় কমে যাওয়ায় অভিভাবকরা তাদের শ্রমঘন কাজে নিয়োজিত করতে বাধ্য হয়েছেন। আর মেয়েদের একটা বড় অংশই দেওয়া হয়েছে বাল্যবিবাহে। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর দেশের অর্ধেকেরও বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রী রয়েছে। বাল্য বিবাহের শিকার। আর প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী শিশুশ্রমে জড়িত। ২০২২ সালে বার্ষিক পরীক্ষা দেয়নি ৪ লাখ ৬২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এই দুই বছরে অন্তত পাঁচ লাখের বেশি প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় বসেননি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের বড় অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং অন্যান্য বেশ কিছু সমস্যা। অনেক দিন ধরে অনেক কষ্ট করে আমরা সেগুলো অর্জন করেছি। বর্তমান উদ্বেগজনক ড্রপআউট হার এবং প্রবণতা সেই লাভগুলিকে ক্ষয় করছে এবং তাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, গত দুই বছরে যারা স্কুল থেকে বাদ পড়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনতে বিশাল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রান্তিক পরিবারগুলোকে তাদের আয় বাড়াতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে হবে।
উপবৃত্তির পরিমাণ ও পরিধি আরও বাড়াতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, করোনার সময় ও পরে আমরা এগুলো দেখিনি।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার দুই বছরে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অন্তত ১৫ শতাংশ শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে। এসব শিশুর বেশির ভাগই দরিদ্র ও প্রান্তিক। পারিবারিক আয় হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতির কারণে লাখ লাখ মেয়ে শিশুকে বাল্যবিবাহে বাধ্য করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূচকে ঝরে পড়ার তথ্য: প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের ঝরে পড়ার তথ্য বিভিন্ন শিক্ষা সূচকে ধরা হয়। ২০২১ এবং ২০২২ সালে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার কারণে বিভিন্ন শ্রেণি থেকে শিশুদের ঝরে পড়া পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থী হ্রাসের কারণে সরকারও ২০২১ এবং ২০২২ সালে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক কম বিতরণ করেছে। পাঠ্যবই ছাপার আগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করে। মাউশি পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালে করোনা মহামারীর কারণে দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০২১ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। এদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী শিশুশ্রমে জড়িত। বাকিদের অনুপস্থিতির সঠিক কারণ জানা যায়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশির পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখা দেশের ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ২০ হাজার ২৯৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
এর আগে, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবাইস) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ব্যানবেইসের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৫২ হাজার। অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬২,০০০ কমেছে।
মাউশির জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় ৬১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেয়। অনুপস্থিত ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫৫ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল।