কক্সবাজার-চট্টগ্রাম শহর ‘মাদকপ্রবণ এলাকা’
সমুদ্রের নীল জল আর পাহাড়ের সমাহারে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের শহর কক্সবাজার। সুন্দর শহরেরও বদনাম আছে। কক্সবাজারকে বলা হয় ইয়াবা ও আইসের ‘গেটওয়ে’। এছাড়া বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটেছে।
এ প্রেক্ষাপটে কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম শহরকে ‘মাদকপ্রবণ অঞ্চল’ ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। দেশে মাদক প্রবেশের সবচেয়ে বড় রুট বিবেচনায় সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে এ দুটি এলাকাকে ‘মাদকপ্রবণ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রোববার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০২ সালে সারাদেশে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯ টাকার ইয়াবা জব্দ করা হয়। ৫৭ লাখ ৪ হাজার ৩০১ টাকার ফেনসিডিল জব্দ করা হয়। আর র্যাব বলছে, গত ১২ মাসে কক্সবাজার থেকে ৭১ লাখ ৫০ হাজার ইয়াবা ও ১৪ কেজি ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করা হয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে প্রায় তিন কিলোমিটার প্রশস্ত নাফ নদী। এর বাইরে রয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, আগে শুধু এই নদী পার হয়ে ইয়াবা আসত, কিন্তু এখন বরফ আসছে। বিভিন্ন অভিযানে এসব বিপজ্জনক মাদকের বাহক গ্রেফতার হলেও মাদক ব্যবসার মূল মালিক ও পৃষ্ঠপোষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও জনপ্রতিনিধিরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সরকারও কক্সবাজারকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ নেয়। একসময় প্রায় প্রতিদিনই মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হতো।
সূত্র জানায়, কক্সবাজারে প্রতি ৯৫ জনের জন্য একটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। ঢাকায় এই হার প্রতি ১৩৮ জনে একজন; চট্টগ্রামে ১৫৫টি, রাজশাহীতে ১৭৪টি, বরিশালে ১৮১টি, পঞ্চগড়ে ২৫৭টি, রংপুরে ২৬৩টি, সিলেটে ২৬৯টি এবং খুলনায় ৪৬১টি মামলা রয়েছে। কক্সবাজারে ৯০ হাজারের বেশি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। গত জানুয়ারিতে ৩২৯টি মামলা ছিল। আগের মাসে ৩১২ টি মামলা ছিল।
২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারাদেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। এরপর পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর পৃথক পৃথক মাদক নিয়ন্ত্রণ অভিযান পরিচালনা করে। এরপর একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়। পরে কক্সবাজারের মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়। এখন আত্মসমর্পণ করা অনেকেই আবার মাদক ব্যবসায় জড়িত। ‘বন্দুকযুদ্ধ’, আত্মসমর্পণ, অভিযান, গ্রেপ্তার, মামলা-সব ‘বটিকা’ ব্যর্থ। এখন সরকার কক্সবাজার ও চট্টগ্রামকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করলে তা মাদক নির্মূলে কতটা কার্যকর তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, কমিটির আগের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণার বিষয়টি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। গতকালের বৈঠকে সেই সুপারিশের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সকল বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয় সভায় বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। সভায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা হিসেবে ঘোষণার একটি রূপরেখা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে আরও তৎপরতা চলছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিভাগও জানিয়েছে।
জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিটির আগের বৈঠকে নিরাপত্তা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বিষয়টি তুলে ধরেন। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও উৎপাদক দেশের কাছাকাছি হওয়ায় এবং ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদক পাচারের শিকার হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ভারত থেকে ইনজেকশনযোগ্য মাদক।
পরে আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী মাদক চোরাচালান রোধে সীমান্ত নিরাপত্তা, স্যাটেলাইট ইমেজ প্রযুক্তি স্থাপন এবং চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার এলাকাকে মাদকপ্রবণ এলাকা হিসেবে ঘোষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
ওই বৈঠকে কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী বলেন, গত তিন বছরে মিয়ানমার সীমান্তে বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে যে পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক জব্দ করা হয়েছে তার মূল্য এক হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি।
বৈঠকে দশম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. ফখরুল আহসান বলেন, রোহিঙ্গারা যা করছে তা দেশের স্বার্থবিরোধী। তারা রাতের বেলায় ওপারে গিয়ে মাদক পাচারের জন্য তাদের সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ করে। উদ্ধারকৃত মাদক প্রধানত ২ বা ৩ শতাংশ।