এমডি মাজেদে শেষ কর্ণফুলী গ্যাস
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) এমডি বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে এবং তার সঙ্গে কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার যোগসাজশ পেট্রোবাংলার একাধিক উচ্চপর্যায়ের তদন্তে পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া, সংযোগ বিচ্ছিন্ন লাইন পুনঃসংযোগ, লোড বৃদ্ধিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আসামিদের মধ্যে অন্যরা হলেন- জ্বালানি খাতের এই কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং-উত্তর) মো. শফিউল আজম খান, মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং-সাউথ) আমিনুর রহমান ও মহাব্যবস্থাপক (কোম্পানি সচিব) মোঃ ফিরোজ খান।
তারা পদোন্নতির নিয়ম ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানেননি বলে জানা গেছে। এই চক্রটি পরিচালনা পর্ষদকে বাইপাস করে এবং নিজের ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নেয়। নিজেদের লোক দিয়ে নীতিনির্ধারণী কমিটি গঠন, যোগ্য লোক বাদ দিয়ে পছন্দের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদ বরাদ্দ, তদন্ত কমিটির মাধ্যমে অপছন্দের কর্মকর্তাদের হয়রানিসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তারা।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে দায়ী করা হলেও এই চারজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে অভিযুক্তকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে পেট্রোবাংলা।
আল মামুনকে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন পেট্রোবাংলার প্রথম পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী আলী তদন্তে বেশিরভাগ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আলী আল মামুনের প্রতিবেদনে ৯টি বিষয়ে বেশ কিছু কাজে গুরুতর অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। এসব অনিয়ম আরও বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখতে এবং দোষীদের চিহ্নিত করতে ২৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে পেট্রোবাংলা। চার সদস্যের এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন পেট্রোবাংলার পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আলী ইকবাল। নুরুল্লাহ কমিটি ঘটনাস্থল তদন্ত করে গত এপ্রিলে পেট্রোবাংলার কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে এমডিসহ চারজনকে অনিয়ম-দুর্নীতির মালিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এর আগেও দুদকের তদন্তে কেজিডিসিএলে নিয়োগ ও পদোন্নতি জালিয়াতি ধরা পড়ে। ২০১৪-১৫ সালের দিকে, ৩৭ জন প্রার্থী নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করলেও সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে চাকরি দেওয়া হয়। ওই সময়ের এমডি জোর করে দুই ছেলেকে কেজিডিসিএলে নিয়োগ দেন। জালিয়াতি ধামাচাপা দিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার নথিও সংরক্ষণ করা হয়নি। এ সময় দুদক অনুসন্ধান করে নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে কিছু পায়নি।
লিংক বাণিজ্য: তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই কর্মকর্তারা সরকারি নিয়ম-নীতিকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে লিংক বাণিজ্যের মাধ্যমে পকেট ভর্তি করেছেন।
কেজিডিসিএল বকেয়া বিলের কারণে গত বছরের ৭ জুন গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এরপর কারখানার ক্যাপটিভ সেক্টর মিটারে ত্রুটি ধরা পড়ে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আরও ছয় মাস পরে পরীক্ষাটি পরিচালিত হয়েছিল এবং মিটার পরীক্ষার আগে পুনরায় সংযোগের জন্য নির্ধারিত কমিটি বাতিল করা হয়েছিল। পরে এমডির নেতৃত্বাধীন চক্র পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে শুধু মার্কেটিং বিভাগের লোকজন নিয়ে নতুন কমিটি করে। এটি সহজেই মিটারে অবৈধ হস্তক্ষেপ মাস্ক করে পুনরায় সংযোগের সুপারিশ করে৷ ত্রুটিপূর্ণ মিটারের কারণে জরিমানাসহ বকেয়া বকেয়া আদায় না করে কারখানাটি পুনরায় সংযোগ দেয় সিন্ডিকেট। গ্যাস বিপণন নীতি ২০১৪ অনুযায়ী, জরিমানাসহ বকেয়া আদায় ছাড়া কোনো পুনঃসংযোগ করা যাবে না। এ জন্য তদন্ত কমিটির এমডি এম এ মাজেদ, জিএম শফিউল আজম খান, নথি উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোঃ ফিরোজ খান ও ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) বাসুদেব বিশ্বাসকে দায়ী করেন।
এছাড়া বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে একই কারখানার ৯০০ কিলোওয়াট জেনারেটরে নতুন গ্যাস সংযোগ দিয়েছে একই সিন্ডিকেট। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদ, মহাব্যবস্থাপক শফিউল আজম খান এবং দলিল উপস্থাপক সৈয়দ মোরশেদ উল্লাহ, সৌমেন ব্যানার্জি ও প্রকৌশলী শামসুল করিমকে দায়ী করেছে কমিটি।
চক্রটি বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ক্যাপটিভ সেক্টরে ডায়মন্ড সিমেন্টের নতুন সংযোগ দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডায়মন্ড সিমেন্টের গ্যাস সংযোগের আবেদনের পর, ২২ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে কেজিডিসিএল-এর ১৬০ তম বোর্ড সভায় এটি তোলা হয়েছিল। সেই বৈঠকে সেই প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়নি। পরে বোর্ড মিটিংয়ে না নিয়ে ম্যানেজমেন্ট সিন্ডিকেট নিজেই ডায়মন্ড সিমেন্টে গ্যাস সংযোগ দেয়। তদন্ত কমিটি এমডি এম এ মাজেদ, জিএম শফিউল আজম এবং দলিল উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা কবির আহমেদ, প্রজিত বড়ুয়া ও শামসুল করিমকে দায়ী করে।
KGDCL আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জন্য ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১-এ একটি ডিমান্ড নোট জারি করেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর বোর্ড সভায় এই সংযোগ অনুমোদনের বিষয়টি উঠেছিল। তবে বোর্ড সভায় তা তোলার আগে কেজিডিসিএলের চেয়ারম্যান তৎকালীন জ্বালানি সচিব আনিচুর রহমান এ বিষয়ে তদন্ত করতে বলেন।
ম্যান্ড নোট ইস্যু অভিযোগ এবং পরবর্তী সভায় উত্থাপন. তিনি বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নিতে হবে। তবে চেয়ারম্যানের নির্দেশে বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে তদন্তের পরিবর্তে স্ক্রুটিনি লেখা হয়। পরে তদন্ত ছাড়াই আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। আবার কোম্পানির জোন-১ ডেসপ্যাচ বুকের পাতা পরিবর্তন করে জালালাবাদ সিএনজির ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দেওয়ার জন্য আল রাজির পরিবর্তে ভুয়া এন্ট্রি করা হয়। তদন্ত কমিটি এসব অনিয়মের জন্য এমডি এম এ মাজেদ, কোম্পানি সচিব ফিরোজ খান ও জিএম শফিউল আজমকে দায়ী করে।