জাতীয়

উপকূলের জন্য নতুন হুমকি হচ্ছে জোয়ার-ভাটা

জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে উপকূল। বছরের পর বছর পানি বাড়ছে, আগের বছরের চেয়ে বেশি এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এটি বিশেষ করে ভ্রাক্কলের পূর্ণিমার সময় বেশি ঘটে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ উপকূলের নদীগুলো আর অমাবস্যা-পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ারের পানি ধরে রাখতে পারে না। এলাকায় পানি ঢুকছে। পুকুরের মাছ তাতে ভাসছে; ফসলহানি ও জমির লবণাক্ততা এবং ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। যেসব এলাকা আগে উঁচু ও সুরক্ষিত ছিল, সেগুলো এখন জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গত তিন দিন ধরে বিরতিহীন বৃষ্টি ও উচ্চ জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। অন্তত ১৫টি জেলার কয়েক লাখ পরিবার জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের কারণেই এই উচ্চ জোয়ার। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলীয় নদীগুলোতে এত উচ্চতার জোয়ার দেখা যায়নি। এ অবস্থাকে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য অশুভ লক্ষণ বলেও মনে করছেন তারা।

নদীতে ভাটার এই প্রবণতা এক দশক আগে শুরু হয়েছিল। এটি ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডোরের সাথে শুরু হয়েছিল। তারপরে ঝড় আঘাত করার সাথে সাথে জোয়ারের পরিমাণ বাড়তে থাকে। শুধু ঘূর্ণিঝড়ই নয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারও হয় লোকালয়ে ৮ থেকে ১৪ ফুট। এই অঞ্চলের মাটি, পানি, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের উপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে।

গত তিন দিন ধরে বরিশাল ও দক্ষিণ উপকূলীয় জেলা ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় জোয়ার ভাটার কারণে দিন ও রাতে দুই দফায় ভাসছে। এতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় উপকূলীয় হাজার হাজার পরিবার আশ্রয়হীন বিভিন্ন বাঁধ ও উঁচু স্থানে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।

তিন দিন ধরে জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। সম্প্রতি সমুদ্রে নিম্নচাপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জোয়ারের পানিতে বন্যা বন্যার কারণে প্রাণীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বন বিভাগের এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বলেন, পুরো বন প্লাবিত হওয়ায় খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব নয়। এ সময় কোনো প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সে তথ্য সঠিকভাবে পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।

পানি থেকে বন্যপ্রাণী রক্ষার পরিকল্পনা স্থবির হয়ে পড়েছে। গত আগস্ট মাসের পূর্ণিমায় সুন্দরবন দুবার প্লাবিত হয়।

বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলার অন্তত সাত শতাধিক মাছের খাঁচা ও মাছের পুকুর জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। পানিতে আটকা পড়েছে অন্তত তিন হাজার পরিবার। নগরীতে পানি বেড়েছে।

পায়রা নদীর প্রবল স্রোতে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। মঙ্গলবার বিকেলে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট বেড়ে উপজেলার দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়নের মেহেন্দাবাদ পয়েন্টে বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়।

বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, মঙ্গলবার বরগুনার প্রধান তিনটি নদীতে (পায়রা-বিশখালী-বালেশ্বর) জোয়ারের পানি বন্যা সীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার অন্তত ২৫টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। বেশিরভাগ খনিই ডুবে গেছে। ভান্ডারিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের বাড়ির আঙিনা, ঘরের মেঝে ও রান্নার চুলা পানিতে তলিয়ে গেছে। দুর্ভোগে পড়েছে শত শত পরিবার।

নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ায় পানিতে তলিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক গ্রাম। নিঝুমদ্বীপে ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। এখানে কোনো বাঁধ নেই। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি।

জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়েছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতি উপজেলার প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ। হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া ঘেরের অসংখ্য পুকুর ও মাছ ভেসে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। মেঘনা নদীর জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট বেড়েছে। কৃষি বিভাগ জানায়, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ১৪টি ইউনিয়নের ৫৫ হেক্টর মাশকলাই, সদ্য বপন করা চারা ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

বৃষ্টির কারণে বগুড়া শহরের বিভিন্ন এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বগুড়া আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশেকুর রহমান জানান, গতকাল সকাল ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত জেলায় ১০৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরের বেশ কয়েকটি নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে দুই ফুট ওপরে উঠেছে। জীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় ৩৫টি পয়েন্টে প্রায় ৬২ কিমি বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। এদিকে আশাশুনির খাজারা ইউনিয়নের গদাইপুরে খোলপেটুয়া নদীর ১০ ফাঁদ বাঁধ ভেঙে ২০০ বিঘা মাছ ধরার মাঠ প্লাবিত হয়েছে। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী কাজে সংস্কার করা হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বগুড়ায় দেশের সর্বোচ্চ ১৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীতে ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকায় সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল রেখেছে আবহাওয়া অধিদফতর।

মন্তব্য করুন