উত্তপ্ত বরিশাল।মেয়র সাদিক কোণঠাসা, প্রশাসনও কাঠগড়ায়
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বুধবার রাতে ইউএনওর বাড়িতে হামলার দুটি মামলায় তাকে প্রধান আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন এই বিষয়ে ইউএনওর পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা মেয়র সাদিকের পাশে নেই। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশসহ সিটি কর্পোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরও মেয়র থেকে তাদের দূরত্ব বজায় রাখছেন। যদিও ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সরাসরি বরিশালের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা এই ইস্যুতে নিজেদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এদিকে, এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া বেশ কয়েকজন সাবেক আমলাও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফৌজুল কবির খান বলেন, প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন যে ভাষা ব্যবহার করেছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের বক্তব্য মোটেও প্রকাশ্যে আনা উচিত ছিল না। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কোনো দলের নয়, কারও বিরুদ্ধে নয়।
একাধিক কর্মকর্তার মতে, এই প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সংগঠনকে সম্পূর্ণ প্রতিপক্ষ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা কোনো রাজনীতি করেন না। তারপরও তারা রাজনৈতিক ভাষায় নোটিশ দিয়েছে। প্রথমে তাদের মধ্যে কি ঘটেছিল তা তাদের দেখা দরকার ছিল। একজন সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে হঠাৎ গ্রেফতার করার বিষয়ে একজন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা কথা বলতে পারেন না। বিষয়টি প্রশাসন ক্যাডারের জন্য খুবই খারাপ হয়ে গেছে। তারা সাধারণ মানুষের দ্বারা বিতর্কিত হচ্ছে। এই উপলক্ষে প্রশাসন ক্যাডারের বিপরীত দিক সমালোচনা করছে।
বাংলাদেশ সার্ভিস বিধিতে বলা হয়েছে যে, কোন সরকারী কর্মকর্তা কোন রাজনৈতিক বা সরকারি কার্যক্রম ব্যাহত করার জন্য প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে পারবেন না। কিন্তু আপনি কর্মকর্তাদের কল্যাণের কথা বলতে পারেন। এটি শালীন এবং মার্জিত ভাষায় হওয়া উচিত।
অতি সাধারণ সরকারি কর্মচারী আইন বইয়ের লেখক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। এই ঘটনাটি অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন এমন একটি ট্রেড ইউনিয়ন নয় যা এই ধরনের বিবৃতি দেবে।
সংশ্লিষ্ট দলগুলো বলছে, পুরো বিষয়টি উভয় পক্ষের জন্য খুবই সংবেদনশীল। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা এ বিষয়ে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। আবার, ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ কর্তৃক জারি করা বিজ্ঞপ্তি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। সংগঠনের পূর্বের সকল বিবৃতি সভাপতি ও মহাসচিব যৌথভাবে স্বাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সভাপতি কবির বিন আনোয়ার একাই তাদের স্বাক্ষর করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের মহাসচিব ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমান গতকাল রাতে বলেন, সেদিন তিনি নারায়ণগঞ্জে ছিলেন। তিনি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সভাপতি কবির বিন আনোয়ারের অফিসিয়াল সেল নম্বর এবং ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা রিসিভ করা হয়নি।
অনেকে বলেন, বরিশাল আওয়ামী লীগে প্রশাসন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। কবির বিন আনোয়ার, প্রশাসন ক্যাডারের সভাপতি, সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, আর এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হলেন বরিশাল সদরের সাংসদ জাহিদ ফারুক। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক সুখকর নয়, এই খবর বরিশালের রাজনীতিতে একটি ওপেন সিক্রেট। ঘটনার রাতে সিটি কর্পোরেশন এবং মেয়রের ব্যক্তিগত দল উপজেলা প্রশাসনের চত্বরে লাগানো শোক দিবসের ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণের জন্য একটি যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। পোস্টার ও ব্যানার লাগিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। প্রথম পর্যায়ে তর্কের এক পর্যায়ে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদককে ইউএনওর লোকজন আটক করে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে এক ঘন্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আবার তাকে উদ্ধার করতে উপজেলা প্রশাসনে প্রবেশ করে। এরপর শুরু হয় তুলকালাম।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মেয়রের বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, যখন তিনি প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সঙ্গে মতবিরোধে ছিলেন। হিরনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এমপি নির্বাচিত হলেও রাজনীতিতে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেননি। এরপর আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তার ছেলেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। সাদিক আবদুল্লাহকে নতুন মুখ হিসেবে মেয়র পদে মনোনীত করা হয়। তার ছেলে নির্বাচিত হওয়ার পর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশালের রাজনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, জাহিদ ফারুক সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হলেও দলীয় কাজে কখনো নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। এক্ষেত্রে মেয়র সাদিক প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান।