আলীপুর মডেল কলেজ রাজশাহী।অবৈধ ১৬ শিক্ষক-প্রশিক্ষক নিয়োগ, এমপিও জালিয়াতি
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আলীপুর মডেল কলেজে অভিনব অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষক, গ্রন্থাগারিক ও প্রভাষক পদে অনিয়মিতভাবে ১৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়োগের জন্য গঠিত বোর্ডে বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারি কলেজের শিক্ষক রাখার নিয়ম থাকলেও তা হয়নি। বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের রাখা হয় অনিয়মিতভাবে। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া এসব শিক্ষকদের এমপিও করা হয়েছে বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে। কলেজটি ২০১১ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও তার সাত বছর আগে, ২০০৪ সালে কলেজটিকে এমপিওভুক্ত করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অনিয়মের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাজশাহী বিএনপির এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি থাকায় তার নেতৃত্বেই এসব অনিয়ম হয়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩-এ, আলিপুর মডেল কলেজে একটি নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। এ নিয়োগ বোর্ডের সভাপতিত্ব করেন কলেজের সভাপতি নাদিম মোস্তফা।
কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কলেজের শিক্ষককে এই নিয়োগ বোর্ডের বিষয় বিশেষজ্ঞ করা হয় না। বেসরকারি কলেজ পুঠিয়ার পচামারিয়া কলেজের ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক আবদুর রাজ্জাক অতনিক, অর্থনীতির শিক্ষক স্বপন কুমার সাহা, কম্পিউটার শিক্ষার প্রভাষক সাইফুল ইসলাম, ধোকরাকুল কলেজের গ্রন্থাগারিক গুলশান আরা খাতুন এবং পৌরনীতিবিদ আবদুর রহিম খন্দকার। প্রভাষক, বিষয় বিশেষজ্ঞ করা হয়।
জামাল উদ্দিন অর্থনীতির, নগরনীতির মাসুদ রানা, যুক্তিবিদ্যার আবদুল কাদের চৌধুরী, মনোবিজ্ঞানের মমিন উদ্দিন, ব্যবস্থাপনার আবদুর রাজ্জাক, হিসাববিজ্ঞানের খাদিজাতুল কোবরা, সেক্রেটারি সায়েন্সের বজলুর রশীদ, কম্পিউটারের জাহাঙ্গীর আলম, আসাদুজ্জামান শেখ, আসাদুজ্জামান খান, কম্পিউটার বিভাগের অধ্যাপক ড. গণিতের জিল্লুর রহমান, ভূগোল বিভাগের সাইফুল ইসলাম, ইসলামের ইতিহাসের সাইফুল ইসলাম, গ্রন্থাগারিক হিসেবে রূপালী পারভীন, প্রভাষক পদে মনোবিজ্ঞানের আবু হানিফ, জীববিজ্ঞানের ইমান উদ্দিন, রসায়নের রাশেদা খাতুন, তৃতীয় শ্রেণির তিনজন ও চতুর্থ শ্রেণির চারজন কর্মচারী। তবে কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে শিক্ষার্থীরা এ কলেজে ভর্তি হতে চায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, নিয়োগ বোর্ডে বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডিজি ও সরকারি কলেজ শিক্ষকদের একজন প্রতিনিধি থাকতে হবে। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা বিষয় বিশেষজ্ঞ হতে পারেন না। এমনকি নতুন সরকারি কলেজের শিক্ষকরাও বিষয় বিশেষজ্ঞ হতে পারবেন না। যদি তাই হয়, নিয়োগ অবশ্যই অবৈধ এবং সন্দেহজনক হতে হবে।
এ বিষয়ে পাচামারিয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ বিষ্ণু পদ সাহা বলেন, ওই নিয়োগ বোর্ডে তৎকালীন ডিজির প্রতিনিধি আবদুল জলিলের অনুরোধে বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রভাষক পাঠিয়েছিলাম। নিয়ম সম্পর্কে জানতাম না। এটা অনিয়ম কিনা তা জানা যায়নি।
কলেজের তৎকালীন সভাপতি ও বিএনপির প্রভাবশালী সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা অবৈধ শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক দিন আগের কথা, তাই মনে করতে পারছি না।’ কলেজের বর্তমান সভাপতি ও আওয়ামী লীগ মনোনীত দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি খুঁজে বের করবো।
এদিকে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান মারা গেলে পরবর্তীতে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্য থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে কলেজে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। একাধিক শিক্ষক জানান, বর্তমান অধ্যক্ষ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কয়েক মাস ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন।
শুধু নিয়োগে জালিয়াতি নয়, কলেজটিকে এমপিও করার ক্ষেত্রেও জালিয়াতি হয়েছে। ২০১১ সালে পাঠদানের অনুমতি পেলেও এই অবৈধ শিক্ষক ২০০৪ সালে এমপিও পান। পাঠদানের অনুমোদনের আগেই এমপিওভুক্তির ঘটনা অবিশ্বাস্য। পরে কলেজের বেতন বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর উচ্চ আদালতে আপিল করে ২০২০ সালে কলেজের বেতন শুরু হয়। কিন্তু আগের বেতন দেওয়া হয়নি। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ আগের বেতন বকেয়া চেয়ে হাইকোর্টে আরেকটি রিট করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষাগত স্বীকৃতি আগে আসতে হবে। পরে এমপিওভুক্ত। একাডেমিক স্বীকৃতি ছাড়া এটি একটি বৈধ প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত করে দেখা হবে।’
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, পাঠদানের আগে এমপিও করা যাবে না। নিয়োগ প্রক্রিয়া ও এমপিও সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ তদন্ত করা হবে।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক দীপকেন্দ্র নাথ দাস বলেন, বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা কোনোভাবেই বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ বোর্ডে থাকতে পারবেন না। আর একাডেমিক অনুমোদনের আগে এমপিও হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা চরম জালিয়াতি ও অনিয়ম।