‘আমাকে আমার বাবার মুখটা দেখতে দাও’।নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মকবুল হোসেন নিহত
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে হালিমা বেগম নামে এক নারী চিৎকার করছিলেন। তার পাশে ৭ বছরের একটি শিশু। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তারা হলেন রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে নিহত মকবুল হোসেনের স্ত্রী ও মেয়ে। কিছু স্বজন তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোনো স্বস্তিই তাদের কষ্টকে ঢাকতে যথেষ্ট ছিল না। স্বামীর জন্য কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যান হালিমা। ছোট্ট মিথিলা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, বাবার মুখ দেখতে দাও। ফিরিয়ে দাও বাবাকে আমি এখন কার সাথে ঘুমাবো? কে আমাকে ভালোবাসবে? এতিম হয়ে গেলাম!’
মকবুলের স্ত্রী হালিমা বেগমের আহাজারী- ‘আমগোরে কার কাছে রাইখা গেলা? সকালে কথা হয়নি। আমগোরে কার কাছে রাইখা গেলা? আল্লাহর কি কোন বিচার নাই? গুলি আমারেও ঝাঁঝরা কইরা দিত। কে দেখবে আমায়; আমার মাইরে কে দেখব? ।মালামাল আনতে ১০০০ টাকা ধার বের হয়েছিল। আমাকে ফোন দিয়া কই – মায়ার লগে বিশৃঙ্খলা করবেন না। সে যা খায় তাকে খেতে দাও। এটা কি হলো? ১০০০ টাকার মালামাল আনতে গিয়ে একবারেই হারিয়ে গেল!’
হালিমা বেগম বলেন, আমরা রাজনীতি বুঝি না। আমার স্বামী রাজনীতি করেন না। দুবেলা ভাত পেতে ঘাম ঝরাতে হয়। আমি ১০ বছর আগে প্রেমের করে বিয়ে করেছি। নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার কথা ছিল না মকবুলের। তবে তিনি বিএনপিকে সমর্থন করতেন। মকবুল কেন নয়াপল্টনে এসেছেন বুঝতে পারছি না। যে আমার মেয়েকে এতিম করেছে; আমাকে বিধবা করেছে – আমি উত্তর চাই। আমি তাদের নাম জানতে চাই। আমি বিচার চাই। আমার স্বামী কাজের জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল।
পল্টন সংঘর্ষে নিহত মকবুলের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার উদিমেরচর গ্রামে। তার পিতা এ. সামাদ। মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টরের লালমাটিয়া এ-ব্লকের ১২ নম্বর লেনে থাকতেন। বাড়ির পাশে একটি রুম ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী জুতার চামড়ার নকশার কাজ শুরু করেন। তার ৭ বছরের একমাত্র মেয়ে মিথিলা আক্তার স্থানীয় মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
গতকাল রাতে বিএনপির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, নিহত মকবুল পল্লবী থানার ৫নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা ছিলেন। তবে তার অবস্থান উল্লেখ করা হয়নি।
মকবুলের বড় ভাই আবদুর রহমান বলেন, চার ভাইয়ের মধ্যে মকবুল সবার ছোট। আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সকালে চকবাজারে যায় কাজের জিনিসপত্র কিনতে। পরে বিকেলে আমরা এ খবর পাই। হয়ত বন্ধুদের সাথে নয়াপল্টনে যাবে। তবে কার সঙ্গে গেল, জানি না।
নিহতের বড় বোন আয়েশা আক্তার জানান, বুধবার সকাল ৯টার দিকে নাস্তা না করে বাসা থেকে বের হয় মকবুল। এরপর সন্ধ্যায় টিভিতে তার মৃত্যুর খবর শুনি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে তার লাশ দেখতে পাই।
জরুরী বিভাগ থেকে মকবুলের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে গেলে সেখানেও ছিল একই করুণ দৃশ্য। মর্গের সামনে স্বজনদের কান্না। স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও মকবুলের বোন, শ্যালিকা ও শাশুড়ি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই।
জানা গেছে, মকবুলকে রক্তাক্ত অবস্থায় যে ব্যক্তি হাসপাতালে নিয়ে আসেন, তার নাম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, মকবুলকে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর বিকেল ৪টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার পিঠে গুলির চিহ্ন রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, মকবুলের মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে।