আদালত থেকে ছিনতাই কান্ডে নতুন মোড়।অপহৃত জঙ্গি সোহেলও তার স্ত্রীসহ নিখোঁজ রয়েছে
দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ও আবু সিদ্দিক সোহেলের অপহরণের তদন্তে সামনে এসেছে। ঘটনার দিন সকালে পুরান ঢাকার আদালত চত্বরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবু সিদ্দিক সোহেলের স্ত্রী ফাতেমা খানম শিখা ও তার আট বছরের শিশু সন্তান ছিলেন। স্বামীর আগমনের খবর তিনি আগেই জানতেন। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওইদিন থেকে শিখা ও তার সন্তান স্বামীসহ নিখোঁজ হয়। সোহেলের স্ত্রী একজন প্রকৌশলী। শিখা ঢাকার একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পাস করেছে। গতকাল তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ ছাড়া বছরের শেষ দিকে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই সন্ত্রাসী ছিনতায়ের ঘটনায় যারা অংশ নিয়েছিল তাদের আস্তানার তথ্য পাওয়া গেছে। পরিকল্পনাকারীরা নারায়ণগঞ্জের বরপা এলাকার কসাইবাড়ি এলাকায় মাকসুদুল আলমের বাড়ির নিচতলায় থাকতেন। তারা ওই বাড়িতে চার মাসের জন্য চাকুরিজিবি হিসেবে একটি রুম ভাড়া নেন। ৩০ নভেম্বর ডাকাতি অভিযানের কয়েকদিন আগে ম্যানেজারকে না জানিয়ে জঙ্গিরা বাড়ি থেকে চলে যায়। ওই বাড়িতে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। সেখানে ছিনতাইর কমান্ডার আয়মান ওরফে মশিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এখন পর্যন্ত তদন্তকারীদের কাছে যে তথ্য এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, দুই সহযোগীকে অপহরণের পুরো পরিকল্পনার সমন্বয় করেছিলেন আয়মান।
ডাকাতিতে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি নারায়ণগঞ্জের কসাইবাড়ির বাড়িতে রাখা ছিল। এরই মধ্যে ওই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র্যাবের গোয়েন্দারা। বালিশ, জঙ্গিদের ব্যবহৃত গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডারসহ অন্য কিছু পাওয়া যায়নি। আলামত হিসেবে পুলিশ এখন বাড়িটি তালা দিয়ে রেখেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিটিসির প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “বরপা নারায়ণগঞ্জের আস্তানার সন্ধান পেয়েছি। সেখান থেকে জঙ্গিরা পালিয়ে গেছে। পলাতক দুই জঙ্গিকে খুঁজতে সর্বোচ্চ ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গি সোহেলের স্ত্রীকে খুঁজতে নানা তৎপরতা চলছে।”
এ ব্যাপারে মাকসুদুলের বাড়ির ব্যবস্থাপক বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, চার মাস আগে এক ব্যক্তি এসে তিন হাজার টাকায় একটি রুম ভাড়া নেয়। তিন বন্ধু একসঙ্গে থাকবে বলেছিল। তিনজনের দাড়ি ছিল। তারা মোটরসাইকেলে যাতায়াত করত। তিনজনই ঢাকায় কাজ করেন বলে জানান। বেশির ভাগ দিনই তারা সকালে বের হতেন এবং সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। নভেম্বর পর্যন্ত বাড়িতেই থাকবেন বলে আগেই জানিয়েছিলেন তাঁরা। ১২ নভেম্বর, তিনজন রুমকে তালাবদ্ধ করে এবং কাউকে কিছু না বলে চলে যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো কাজে আটকে থাকার কারণে হয়তো আসছেন না। কয়েকদিন পর বুঝলাম ওরা পালিয়েছে। মাসিক ভাড়া তিন হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। যাওয়ার আগে ভাড়াও দেননি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, গত ৩০ নভেম্বর অপহৃত জঙ্গি সোহেলের স্ত্রী শিখা ও তার সন্তান পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে ছিলেন এবং খবর পেয়ে তারাও বিস্মিত হয়েছেন। পুরান ঢাকার নারিন্দায় শিখার নানাবাড়ি, গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। শিখার ভাই সাইমনও হিংস্র জঙ্গি। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে সায়মন এখন কারাগারে। স্বামীর সফর উপলক্ষে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসেন শিখা। পরিকল্পনা অনুযায়ী শিখাকেও গোপন আস্তানায় রাখা হয়। পুলিশ এখন পর্যন্ত অপহৃত জঙ্গি সোহেল, শামীম ও শিখরের হদিস পায়নি। তবে তদন্তে জানা গেছে, ডাকাতির ঘটনায় অন্তত চারটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মোটরসাইকেল জব্দ করেছে পুলিশ। ধাপে ধাপে এসব মোটরসাইকেল বিক্রি ডটকম থেকে জাল কাগজপত্র দিয়ে কেনা হয়। ঘটনার দিন ওই দুই জঙ্গিকে মোটরসাইকেলে করে আদালত চত্বর থেকে শ্যামপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মোটরসাইকেল থেকে দুই জঙ্গিকে নামিয়ে আরেক সহযোগীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে তারা পায়ে হেঁটে পালিয়ে যায়। আর সেখানে মোটরসাইকেলের চালকও পরিবর্তন করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ছিনতাইর লক্ষ্য ছিল চারজন। তাদের মধ্য থেকে সবুর ও আরাফাতকে ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারাও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। অন্তত পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়। আনসার আল ইসলামের ১০-১২ সদস্যের একটি দল অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সংগঠনের নতুন সদস্য।