• বাংলা
  • English
  • জাতীয়

    আজ ঐতিহাসিক ১০ই জানুয়ারি।৫০ বছর আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলায় এলেন

    জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানে বন্দি থাকার পরও বাঙালির লড়াইয়ের বাতিঘর ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকার তার দেখানো পথেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার জয়জয়কারে জনগণ তখন বিষাদমাখা জিজ্ঞেস করেছিল, বঙ্গবন্ধু কবে ঢাকায় ফিরছেন?

    ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তীব্র কূটনৈতিক চাপে ছিল পাকিস্তান। যুদ্ধবাজ ইয়াহিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এবং ৯৩,০০০ আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের বন্দী করার পরিপ্রেক্ষিতে, পাকিস্তানের নবনির্বাচিত পিপলস পার্টির নতুন রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া বন্ধ করে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। দুপুরে তেজগাঁও কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে তিন ঘণ্টা রুক্ষ সাগর পাড়ি দিয়ে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছান। ৫০ লাখেরও বেশি মানুষের ভিড়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

    পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, আমি (পাকিস্তান থেকে) ফিরে আসার আগে জনাব ভুট্টো অনুরোধ করেছিলেন সামান্য হলেও দুই অংশের (বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) মধ্যে বন্ধন বজায় রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম, আমার লোকজনের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি কিছু বলতে পারব না। আজ আমি বলতে চাই, মিস্টার ভুট্টো, খুশি থাকুন, আপনার সাথে আর নয়। মরবে, তবু বাঙালি তাদের স্বাধীনতা হারাতে পারবে না।

    বঙ্গবন্ধুকে দেখতে বিমানবন্দরে জড়ো হয় লাখো তরুণ-তরুণী। বিমানবন্দরে ৩১ রাউন্ড আর্টিলারি ফায়ার দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানো হয়। কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। বিগলে বাজানো হয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’। স্বাধীন বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানালে বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুলকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনও বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করলে একই দৃশ্য ফুটে ওঠে।

    ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু একটি বিশেষ ফ্লাইটে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির সিহালা পুলিশ রেস্ট হাউস ত্যাগ করেন এবং পরদিন সকাল ৬টায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। তবে নিরাপত্তার কারণে বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আগমনের খবর গোপন ছিল। পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও মুক্তি পান। বিবিসি অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আগমনের খবর বিশেষ বুলেটিন হিসেবে প্রচার শুরু করে। লন্ডনে একটি বিশেষ টেলিগ্রাফ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দলে দলে লোকজন লন্ডনে আসতে শুরু করে। বিমানবন্দরে বিরোধীদলীয় নেতা ড. হ্যারল্ড উইলসন সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানান। এরপর বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে ক্লারিজেস হোটেলে নিয়ে যান। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে বাংলাদেশে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ও অন্যান্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বক্তব্য রাখেন তার সন্তান শেখ কামাল, শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী), রাসেল ও বেগম মুজিব। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের লক্ষ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেছেন। এদিন বঙ্গবন্ধু আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে হোটেলের সামনে সাংবাদিকদের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বঙ্গবন্ধু।

    এদিকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় বাংলাদেশ। ৯ জানুয়ারি খবরটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দেশি-বিদেশি রাজনীতিবিদ ও শুভানুধ্যায়ীরাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ভারতের দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে একটি রাজকীয় ফ্লাইটে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য ভারত ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তৃতা করেন। এরপর দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছান। কোটি বাঙালির বিজয় স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত বাঙালির বিজয় পূর্ণতা পায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আজ আমার জীবনের সাধ পূরণ হলো।

    মন্তব্য করুন